গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা, নেপথ্যে তৃতীয়পক্ষ

গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা, নেপথ্যে তৃতীয়পক্ষ – কয়েকটি দাবিতে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। একইসঙ্গে চাকরিচ্যুত শ্রমিক ও চাকরিপ্রত্যাশীরাও চাকরির দাবির পাশাপাশি নিয়োগে নারী-পুরুষের সমতা চেয়ে সড়ক অবরোধ করেছেন। এ সময় কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর চালানো হয়। ফলে অস্থিরতা দেখা দেয় সাভার-আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চল এলাকায়। এই অস্থিরতা ওষুধ, খাদ্যসহ বিভিন্ন শিল্পেও ছড়িয়ে পড়ছে। তবে অস্থিরতার পেছনে তৃতীয়পক্ষের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

 

গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা, নেপথ্যে তৃতীয়পক্ষ

 

বিশেষ করে সরকার পতনের পর ঝুট ব্যবসার দখল নিতে তৎপরতা চালাচ্ছেন বিএনপির নেতারা। সেইসঙ্গে বেশিরভাগ কারখানায় আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া তারা। এজন্য বাইরের লোকদের দিয়ে বিক্ষোভ ও সহিংসতা ছড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ কারখানা মালিকদের।

ছুটি ঘোষণা করা হয় গাজীপুরের ৪৫ কারখানায়

বিক্ষোভের জেরে গত সপ্তাহে গাজীপুরে ৪৫টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এর বাইরে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের একটি কারখানা বন্ধ আছে। একই সময়ে গাজীপুরে ১১টি তৈরি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর হয়েছে। দুটি কারখানায় লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। শিল্প পুলিশ ও বিজিএমইএ এ তথ্য জানিয়েছে।

পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টঙ্গী বিসিক এলাকা, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর এবং কোনাবাড়ির যেসব কারখানায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন তাদের দাবি ছিল- নিয়োগে নারী-পুরুষের সমতা, বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্য না করা। তবে এবারের আন্দোলনে বিভিন্ন দাবি নিয়ে ওষুধশিল্প, বাটা জুতা এবং সিরামিক কারখানার শ্রমিকরাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। সব মিলিয়ে পোশাক, ওষুধ এবং সিরামিক কারখানাগুলোতে দেখা দেয় অস্থিরতা। তবে চলতি সপ্তাহে সবকটি কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ সোমবার টঙ্গীতে আগস্ট মাসের বেতনসহ ১৩ দফা দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেইজ লিমিটেড ও ব্রাভো অ্যাপারেলসের শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করেছেন।

আন্দোলনরত শ্রমিকরা ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, কোনো শ্রমিকের ওপর হয়রানি ও অত্যাচার করা যাবে না। অফিসের প্রশাসন বিভাগের কমপ্লায়েন্স কোনো কোম্পানির আওতায় থাকতে পারবে না।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “শ্রমিক প্রতিনিধিসহ মালিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে।”

কারখানার মালিকরা জানিয়েছেন, ছাত্র অন্দোলনের পর থেকে পুলিশ কাউকে কোনো বাধা দিচ্ছে না। ফলে শ্রমিক বিক্ষোভে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকরা কারখানার বাইরে বিক্ষোভ করে মহাসড়ক অবরোধ করছেন। কারখানার গেটে ধাক্কাধাক্কি করছেন। শান্তিপূর্ণ শ্রমিকদের বের করে আনছেন। আবার যেসব কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে যাচ্ছেন না সেসব কারখানায় ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। এখানে তৃতীয় পক্ষ বিক্ষোভে ইন্ধন দিচ্ছে। তাদের নাম বলা যাবে না। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করছেন।

 

শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা

 

 

কারা বিক্ষোভে নেতৃত্বে দিচ্ছে জানতে চাইলে বাঘের বাজার এলাকার মণ্ডল ইন্টিমেন্টস পোশাক কারখানার শ্রমিক জুয়েল রানা ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “কয়েকজন ব্যক্তি শ্রমিক নেতা পরিচয় দিয়ে শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবির কথা বলে আমাদেরকে আন্দোলনে অংশ নিতে বলছেন। এসব শ্রমিক নেতাকে আমরা আগে কখনও দেখিনি। তারা কেন আমাদেরকে বিক্ষোভ করতে বলছেন, তাও জানি না।”

একই কারখানার শ্রমিক নূপুর আক্তার বলেন, “বিক্ষোভে না গেলে কারখানায় হামলা চালায়। হামলাকারীরা কিশোর। তারা বিভিন্ন কারখানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। তাদের দেখে শ্রমিক মনে হয় না।”

বাঘের বাজার এলাকার গোল্ডেন রিফিট গার্মেন্টসের শ্রমিক কুলসুম আক্তার ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “যেসব ছেলেরা বিক্ষোভ করছে; তাদের আমরা চিনি না। বাধা দিলে কারখানায় ভাঙচুর করে তারা।”

কারা কেন বিক্ষোভ করছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন গাজীপুর মহানগর কমিটির সভাপতি সাইফুল আলম ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “তৃতীয়পক্ষের ইন্ধনে আন্দোলন করা হচ্ছে। কারখানার মালিকানা বা বিজিএমইএর নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। সেইসঙ্গে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও আছে।”

তিনি আরও বলেন, “টিফিন বিল, নাইট বিল, ওভারটাইম বিল বৃদ্ধির দাবি নিয়ে তো কারখানার ভেতরে মালিকদের সঙ্গে বসা যায়। তা-না করে রাস্তায় নেমে অবরোধ-আন্দোলন করা হচ্ছে। আমাদের মূল দাবি ছিল শ্রমিকদের রেশন, কালো আইন বাতিল ও শ্রম আইন প্রণয়ন। কিন্তু এখন নতুন নতুন দাবিতে আন্দোলন চলছে।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কারখানার মালিক ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, একেক কারখানার শ্রমিকরা একেক ধরনের দাবি নিয়ে আসছে। তাদের সংখ্যা কিন্তু বেশি নয়। এতে বোঝা যাচ্ছে কোনো ধরনের সমন্বয় ছাড়াই আন্দোলন করছে তারা।

ভোগড়া বাইপাস সড়ক এলাকার ফারদার ফ্যাশন কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, “নারী শ্রমিকরা কাজে বেশি মনোযোগী হয়। এজন্য কর্তৃপক্ষ নারী শ্রমিকদের নিয়োগে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। অর্ডার না থাকায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিয়োগও কমে গেছে।”

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন গাজীপুরের সভাপতি জিয়াউল কবির খোকন ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “শ্রমিকদের কিছু দাবি যৌক্তিক এবং দীর্ঘদিনের। তবে কোথায় বা কোন জায়গা থেকে তারা সংগঠিত হচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। চাকরিচ্যুতি শ্রমিকরা মূলত আন্দোলন করছেন। দখলদারিত্ব নিতে শ্রমিকদের উসকে দিয়ে পোশাক শিল্পে অস্থিরতা করতে চাচ্ছে একটি পক্ষ। আমরা সাধারণ শ্রমিকদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাচ্ছি।”

পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বরাবরই সরকার পতনের পর নতুন দলের নেতাদের ঝুট ব্যবসা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে শ্রমিকদের উসকে দিয়ে থাকে। শ্রমিকরাও এ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। কালো তালিকাভুক্ত শ্রমিকরাও এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বেশ কয়েকটি কারখানায় কয়েক মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। আন্দোলনের কারণ হিসেবে এগুলোও উঠে এসেছে।

 

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

পোশাকশিল্পের বাইরেও আন্দোলন

গাজীপুরে পোশাকশ্রমিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন ওষুধ এবং সিরামিক কারখানার শ্রমিকরাও বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। গত শনিবার শ্রীপুর উপজেলার নয়নপুর এলাকার জেনফার ফার্মাসিউটিক্যালস বাংলাদেশ লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা কারখানার সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।

বিক্ষোভকারী শ্রমিক শাকিল, মেহেদুল, এনায়েত এবং নূরুজ্জামান ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, কারখানাটি সরকার ঘোষিত শ্রম আইন মেনে চলে না। মানবসম্পদ বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক আজিজুল্লাহ আবেদ দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, গালিগালাজ এবং বেতন বৈষম্য করে আসছেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে এসব দাবি কর্তৃপক্ষের কাছে জানালেও পূরণ হয়নি। এজন্য রাস্তায় নেমেছেন তারা।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম বলেন, “৩ সেপ্টেম্বর আট দফা দাবিতে টঙ্গীর বাটা জুতা কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করেছেন। তারা সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করলে ৩ ঘণ্টা ওভার টাইম এবং দৈনিক ভাতা প্রদান, শ্রমিকদের মূল বেতন ন্যূনতম ১৫ হাজার টাকা করা, প্রতি বছর ২০% বেতন বৃদ্ধি, মূল বেতনের সমপরিমাণ ঈদ বোনাস ও চাকরিতে হয়রানি বন্ধসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করেছেন। ইতোমধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। বেশিরভাগ কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে।”

৪ সেপ্টেম্বর শ্রীপুরের নয়নপুর এলাকায় আর এ কে সিরামিক খারখানার শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধিসহ ৯ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেন। ইতোমধ্যে এই কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। ৩১ আগস্ট কালিয়াকৈরের বোর্ডঘর এলাকার স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধি, চাকরি স্থায়ীকরণ, দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটিসহ ২১ দফা দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। শ্রমিকেরা বলেন, “ন্যায্য দাবির কথা তুলে ধরলেই তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়।”

 

 

কালিয়াকৈরের ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস কারখানার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “মূলত এক কারখানায় দেখে আরেক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্বল হওয়ার কারণে এ সুযোগটা শ্রমিকরা নিয়েছেন। বাইর থেকে একটি পক্ষ তাদের ইন্ধন দিচ্ছে। প্রশাসন সামাল দিতে পারছে না। অস্থায়ী শ্রমিকরা রাজনৈতিক ইন্ধন পাওয়ায় এসব ঘটাচ্ছেন।”

গাজীপুর শিল্প পুলিশের পরিদর্শক রাহয়ান মিয়া বলেন, “ইতোমধ্যে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে কারখানা কর্তৃপক্ষ একটা সমাধানে এসেছে। তবে তাদের বেশিরভাগ দাবি অযৌক্তিক। চলতি সপ্তাহে গাজীপুরের সব কটি কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছেন।”

গাজীপুর শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার গোলাম মোর্শেদ খান ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “অস্থিরতা অনেকটাই কেটে গেছে। তবে দু’একটি কারখানায় মাঝেমধ্যে বিক্ষোভ হচ্ছে; যা সবসময়ই হয়ে থাকে।”

 

আরও পড়ুন:

Leave a Comment